প্রাচীন মিশরীয় মিথ ও ইতিহাস মানব সভ্যতার এক উজ্জ্বল অধ্যায়। এই সভ্যতা শুধু তার বিশাল পিরামিড, মন্দির আর শাসকদের জন্য বিখ্যাত নয়, বরং এর সমৃদ্ধ মিথলজি এবং জটিল সামাজিক কাঠামো আজও গবেষকদের আকর্ষণ করে। মিশরীয় মিথগুলোতে দেবতা, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং জীবনের নানা দিক নিয়ে যে বিশ্বাস প্রচলিত ছিল, তা তাদের সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
মিশরীয় সৃষ্টিতত্ত্ব অনুযায়ী, সৃষ্টির শুরুতে শুধুমাত্র অন্ধকার এবং জল ছিল, যার নাম ছিল নু (Nu)। এই নু থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জন্ম নেন দেবতা আতুম (Atum)। আতুম ছিলেন প্রথম দেবতা, যিনি পরবর্তীকালে অন্যান্য দেব-দেবীর জন্ম দেন। আতুমের হাঁচি থেকে শু (Shu) অর্থাৎ বাতাস এবং থ্যেফনুত (Tefnut) অর্থাৎ আর্দ্রতার সৃষ্টি হয়। শু এবং থ্যেফনুতের মিলনে গেব (Geb) অর্থাৎ পৃথিবী এবং নুট (Nut) অর্থাৎ আকাশের জন্ম হয়। গেব ও নুটের সন্তান ছিলেন ওসিরিস (Osiris), আইসিস (Isis), সেথ (Seth) এবং নেফথিস (Nephthys)। এই দেব-দেবী এবং তাদের মিথগুলো মিশরীয়দের জীবন ও বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।
মিশরীয় pantheon-এ অসংখ্য দেব-দেবী বিদ্যমান, যাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভূমিকা ও ক্ষমতা ছিল। এদের মধ্যে কয়েকজনের পরিচয় নিচে দেওয়া হলো:
ফারাওরা ছিলেন প্রাচীন মিশরের শাসক, যাদেরকে দেবত্বের মর্যাদা দেওয়া হতো। তারা ছিলেন রা-এর প্রতিনিধি এবং মিশরীয় সমাজের কেন্দ্রবিন্দু। ফারাওদের প্রধান কাজ ছিল রাজ্যের সুরক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং প্রজাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা। তারা বিশাল পিরামিড, মন্দির এবং অন্যান্য স্থাপত্য নির্মাণ করে নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিের জানান দিতেন। ফারাওদের জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত বিলাসবহুল এবং তারা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন।
পিরামিডগুলো প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শন। এগুলো মূলত ফারাওদের সমাধি হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। পিরামিড নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল ফারাওদের মৃতদেহ এবং তাদের মূল্যবান সম্পদ রক্ষা করা, যাতে তারা পরকালে নিরাপদে যেতে পারেন। গিজার পিরামিডগুলোর মধ্যে Cheops-এর পিরামিড সবচেয়ে বড় এবং এটি বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে অন্যতম। পিরামিডগুলো নির্মাণের কৌশল এবং এর ভেতরের জটিল নকশা আজও বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করে।
প্রাচীন মিশরীয়দের নিজস্ব লিপি ছিল, যা হায়রোগ্লিফিক (Hieroglyphic) নামে পরিচিত। এই লিপি মূলত ছবি ও চিহ্নের সমন্বয়ে গঠিত। হায়রোগ্লিফিক লিপি মন্দির, সমাধি এবং বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভে খোদাই করা হতো। মিশরীয় সাহিত্যও বেশ সমৃদ্ধ ছিল, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন স্তোত্র, উপদেশমূলক গ্রন্থ, প্রেমের কবিতা এবং গল্প। Book of the Dead মিশরীয় সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে মৃতদের পরকালের যাত্রা এবং বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষার উপায় সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রাচীন মিশরীয় সমাজ ছিল স্তরভিত্তিক। সমাজের শীর্ষে ছিলেন ফারাও, এরপর ছিলেন পুরোহিত, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, লিপিকার এবং সৈন্যরা। সাধারণ মানুষ, যেমন কৃষক ও কারিগর ছিলেন সমাজের নিচের স্তরে। মিশরীয় অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর ছিল। নীল নদের অববাহিকায় উর্বর জমি থাকায় প্রচুর শস্য উৎপাদন হতো। এছাড়াও, মিশরীয়রা বিভিন্ন প্রকার হস্তশিল্প, মৃৎশিল্প এবং ধাতুশিল্পে দক্ষ ছিল। তারা অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করত এবং সোনা, রৌপ্য ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু আমদানি করত।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা মানব ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর মিথ, ইতিহাস, শিল্পকলা এবং স্থাপত্য আজও বিশ্বজুড়ে মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। এই সভ্যতার অবদান মানব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য উত্তরাধিকার রেখে গেছে।