TheInfoPort
ইতিহাস

প্রাচীন মিশরের সমাজব্যবস্থা: দাসত্ব, অর্থনীতি ও দৈনন্দিন জীবন

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা মানব ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এই সভ্যতার সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনীতি এবং দৈনন্দিন জীবন ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং জটিল। আজকের আলোচনায় আমরা প্রাচীন মিশরের সমাজ, অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।

প্রাচীন মিশরের সমাজ ব্যবস্থা

প্রাচীন মিশরের সমাজ ছিল মূলত একটি স্তরভিত্তিক সমাজ। সমাজের একেবারে শীর্ষে ছিলেন ফারাও (Pharaoh), যাঁকে মনে করা হত দেবতা এবং তিনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। ফারাওয়ের পরেই ছিলেন সমাজের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা, যেমন – পুরোহিত, মন্ত্রী এবং অন্যান্য রাজকর্মচারী। এরপর ছিলেন লিপিকার, শিল্পী এবং কারিগর। সমাজের একেবারে নিচের স্তরে ছিলেন কৃষক এবং দাস।

  • ফারাও (Pharaoh): ফারাও ছিলেন মিশরের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা। তাঁর হাতেই ছিল দেশের সমস্ত ক্ষমতা। ফারাওকে সূর্যদেবতা ‘রা’-এর পুত্র হিসেবে মনে করা হত।

  • পুরোহিত: পুরোহিতরা ছিলেন সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁরা মন্দিরের দেখাশোনা করতেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিতেন।

  • রাজকর্মচারী: ফারাওয়ের অধীনে থাকা রাজকর্মচারীরা দেশের শাসনকার্য চালাতেন। এদের মধ্যে উজির ছিলেন প্রধান।

  • লিপিকার: লিপিকারদের কাজ ছিল হিসাব রাখা এবং বিভিন্ন সরকারি নথিপত্র লেখা।

  • শিল্পী ও কারিগর: শিল্পী ও কারিগররা বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম তৈরি করতেন, যা মিশরীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছিল।

  • কৃষক: সমাজের সবচেয়ে বড় অংশ ছিল কৃষকদের। তাঁরা নীল নদের তীরে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

  • দাস: দাসদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না এবং তারা সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে ছিল।

দাসত্ব

প্রাচীন মিশরে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। দাসদের সাধারণত যুদ্ধবন্দী অথবা ঋণ পরিশোধ করতে না পারা মানুষদের মধ্য থেকে আনা হত। তারা বিভিন্ন ধরনের কাজ করত, যেমন – খনি থেকে পাথর তোলা, মন্দির নির্মাণ এবং কৃষিকাজ করা। দাসদের জীবন ছিল অত্যন্ত কঠিন এবং তারা প্রায়শই নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হত। তবে, কিছু দাস বিশেষ সুবিধা পেত এবং তারা সমাজের মূল স্রোতে মিশে যেতে পারত।

প্রাচীন মিশরের অর্থনীতি

প্রাচীন মিশরের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। নীল নদের উর্বর পলিমাটি এবং নিয়মিত বন্যা মিশরকে একটি সমৃদ্ধ কৃষিভিত্তিক দেশে পরিণত করেছিল।

  • কৃষি: মিশরীয়রা গম, বার্লি, যব, এবং বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফল উৎপাদন করত। নীল নদের জল ব্যবহার করে তারা জমিতে সেচ দিত।

  • ব্যবসা-বাণিজ্য: মিশরীয়রা অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্যে বেশ উন্নতি লাভ করেছিল। তারা কাঠ, সোনা, তামা এবং অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী আমদানি করত। অন্যদিকে, মিশর থেকে খাদ্যশস্য, লিনেন কাপড় এবং মৃৎশিল্পের জিনিসপত্র রপ্তানি করা হত।

  • মুদ্রা ব্যবস্থা: প্রাচীন মিশরে মুদ্রার প্রচলন ছিল না। জিনিসপত্র কেনাবেচার জন্য মূলত ‘বার্টার সিস্টেম’ (Barter System) বা পণ্য বিনিময় প্রথা প্রচলিত ছিল।

দৈনন্দিন জীবন

প্রাচীন মিশরীয়দের দৈনন্দিন জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। তাদের জীবনযাত্রা অনেকটাই নির্ভর করত সামাজিক অবস্থানের ওপর।

  • পোশাক: সাধারণ মিশরীয়রা লিনেন কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাক পরত। পুরুষরা সাধারণত হাঁটু পর্যন্ত লম্বা স্কার্ট এবং মহিলারা লম্বা পোশাক পরতেন। ধনী ব্যক্তিরা কারুকার্য করা পোশাক এবং অলঙ্কার ব্যবহার করতেন।

  • খাদ্য: মিশরীয়দের প্রধান খাদ্য ছিল রুটি, মাছ, সবজি এবং ফল। তারা মাংসও খেত, তবে তা সাধারণত বিশেষ অনুষ্ঠানেই পরিবেশন করা হত।

  • বাসস্থান: সাধারণ মিশরীয়দের বাড়িঘর ছিল মাটির তৈরি। ধনী ব্যক্তিরা পাথরের তৈরি বড় বাড়িতে বাস করতেন।

  • বিনোদন: মিশরীয়রা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা এবং বিনোদন পছন্দ করত। তারা সঙ্গীত, নৃত্য এবং বিভিন্ন ধরনের উৎসবে অংশগ্রহণ করত।

  • ধর্মীয় বিশ্বাস: প্রাচীন মিশরীয়রা বহু দেব-দেবীর পূজা করত। তাদের বিশ্বাস ছিল মৃত্যুর পরে মানুষের আত্মা বেঁচে থাকে এবং অন্য এক জগতে যাত্রা করে। তাই তারা মৃতদেহকে মমি করে কবর দিত এবং কবরের সাথে বিভিন্ন জিনিসপত্র রেখে দিত, যা পরকালে কাজে লাগবে বলে তারা মনে করত।