TheInfoPort
Sports

ক্রিকেট ব্যাটের গল্প: উইলো কাঠ থেকে হাই-টেক জিনিস পর্যন্ত

Kaif hossain

ক্রিকেট নিয়ে আমরা সবাই কমবেশি জানি। বল, উইকেট, ব্যাট—এই তিনটা জিনিস ছাড়া ক্রিকেট হয় না। কিন্তু এই ব্যাটটা নিয়ে কখনো ভেবেছেন? ব্যাট মানে তো শুধু কাঠের টুকরো নয়, এটা ক্রিকেটের ইতিহাস, প্রযুক্তি, আর আবেগের একটা বড় অংশ। আজকে আমরা ব্যাটের গল্পই বলবো—কিভাবে একটা সাধারণ কাঠের টুকরো আজকের দিনের হাই-টেক ব্যাটে পরিণত হলো।

শুরুর দিকের ব্যাট: হকি স্টিকের মতো দেখতে

ক্রিকেটের শুরুটা আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগে। তখনকার ব্যাট দেখতে আজকের ব্যাটের চেয়ে একদমই আলাদা ছিল। ১৬০০ শতকের দিকে, ব্যাটগুলো দেখতে অনেকটা হকি স্টিকের মতো বাঁকানো হতো। কারণ তখন বল গড়িয়ে খেলা হতো, আর বাঁকানো ব্যাট দিয়ে বল মারা সহজ ছিল।

তখনকার ব্যাটগুলো সাধারণত স্থানীয় কাঠ দিয়ে বানানো হতো। কিন্তু ক্রিকেটের নিয়ম বদলাতে শুরু করলো, আর ব্যাটের ডিজাইনেও পরিবর্তন আসলো।

উইলো কাঠের রাজত্ব

১৭০০ শতকের দিকে ক্রিকেট ব্যাটের আকার-আকৃতি নিয়ে নিয়ম বানানো শুরু হলো। ১৭৭১ সালে, প্রথমবারের মতো ব্যাটের সর্বোচ্চ প্রস্থ ৪.২৫ ইঞ্চি নির্ধারণ করা হলো। এরপর থেকেই ব্যাটের আকার, ওজন, আর নকশা নিয়ে নিয়ম তৈরি হতে থাকে।

এই সময়েই ক্রিকেট ব্যাট তৈরিতে উইলো কাঠ ব্যবহার শুরু হয়। উইলো কাঠ হালকা, মজবুত, আর বলকে জোরে মেরে পাঠানোর জন্য একদম পারফেক্ট। বিশেষ করে, ইংল্যান্ডের একটা বিশেষ প্রজাতির উইলো, যাকে “ইংলিশ উইলো” বলে, সেটা ব্যাট তৈরির জন্য সবচেয়ে ভালো কাঠ হিসেবে ধরা হয়।

টেকনোলজির যুগ: ব্যাটের বিপ্লব

২০ শতকের দিকে ক্রিকেট ব্যাটে বড় রকমের পরিবর্তন এলো। ব্যাটের প্রান্ত (এজ) আরও মোটা করা হলো, যাতে বলকে আরও জোরে মারা যায়। হ্যান্ডেলগুলো হালকা আর নমনীয় করা হলো, যাতে ব্যাটাররা দ্রুত স্টোক খেলতে পারেন।

এছাড়াও, ব্যাটের উপর প্রতিরক্ষামূলক স্তর যুক্ত করা হলো, যাতে ব্যাট ভেজা বা নষ্ট না হয়। এই সময়ে বিজ্ঞান আর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাট তৈরিতে বড় ভূমিকা পালন করে। ব্যাটের “সুইট স্পট” (যে অংশে বলকে সবচেয়ে জোরে মারা যায়) আরও বড় করা হলো, যা ব্যাটারদের জন্য সুবিধাজনক।

স্টার ক্রিকেটারদের ব্যাটের ম্যাজিক

পেশাদার ক্রিকেটাররা তাদের ব্যাটের ডিজাইনে বড় প্রভাব ফেলেন। যেমন, শচীন টেন্ডুলকার তার ক্যারিয়ারে MRF ব্র্যান্ডের ব্যাট ব্যবহার করতেন, যা তার ব্যাটিং স্টাইলের সাথে মানানসই ছিল। ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান, ভিভিয়ান রিচার্ডসের মতো কিংবদন্তিরাও তাদের ব্যাটের বিশেষ ডিজাইনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

আজকাল, ব্র্যান্ডগুলো যেমন Kookaburra, Gray-Nicolls, এবং GM ক্রিকেটারদের জন্য কাস্টমাইজড ব্যাট বানায়। এই ব্যাটগুলো ব্যাটারদের ওজন, গ্রিপ, আর ব্যালেন্সের পছন্দ অনুযায়ী ডিজাইন করা হয়।

T20 ক্রিকেট আর ব্যাটের নতুন রূপ

T20 ক্রিকেটের আবির্ভাবের সাথে সাথে ব্যাটের ডিজাইনে আরও পরিবর্তন এসেছে। এই ফরম্যাটে দ্রুত রান করার প্রয়োজনীয়তা ব্যাটারদের আরও শক্তিশালী আর ভারী ব্যাট ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছে। আধুনিক ব্যাটগুলোর প্রান্ত (এজ) আগের চেয়ে অনেক মোটা, যা বলকে দূরে পাঠানোর ক্ষমতা বাড়ায়।

তবে, এই পরিবর্তন নিয়ে বিতর্কও আছে। অনেকের মতে, আধুনিক ব্যাটগুলো বোলারদের জন্য অসুবিধাজনক আর খেলার ভারসাম্য নষ্ট করছে।

পরিবেশ আর ভবিষ্যতের ব্যাট

উইলো কাঠের ব্যবহার পরিবেশগত চিন্তার জন্ম দিয়েছে। উইলো গাছের চাষ আর কাঠের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে বন উজাড়ের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য, কিছু গবেষক বিকল্প উপকরণ নিয়ে পরীক্ষা করছেন। যেমন, বাঁশের তৈরি ব্যাট নিয়ে গবেষণা চলছে, যা উইলোর চেয়ে বেশি টেকসই আর শক্তিশালী হতে পারে।

এছাড়াও, 3D প্রিন্টিং আর অন্যান্য প্রযুক্তির ব্যবহার ভবিষ্যতে ব্যাট তৈরিতে বিপ্লব আনতে পারে।

ক্রিকেট ইতিহাসের বিখ্যাত ব্যাট

ক্রিকেট ইতিহাসে কিছু ব্যাট বিশেষ স্থান দখল করে আছে। যেমন, ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের ব্যাট, যা তিনি ১৯৪৮ সালে ব্যবহার করেছিলেন, তা আজও সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। শচীন টেন্ডুলকারের MRF ব্যাটও ক্রিকেট ইতিহাসের একটা বড় অংশ।

ক্রিকেট ব্যাটের গল্প শুধু একটা সরঞ্জামের গল্প নয়, এটা ক্রিকেটের ইতিহাস আর প্রযুক্তির উন্নতির গল্প। উইলো কাঠের সাধারণ ব্যাট থেকে আজকের হাই-টেক ব্যাট পর্যন্ত, এই যাত্রা ক্রিকেটের ক্রমবিকাশেরই একটা অংশ।

ভবিষ্যতে ক্রিকেট ব্যাট আরও উন্নত আর টেকসই হবে কি না, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। কিন্তু একথা নিশ্চিত যে, ক্রিকেট ব্যাট সবসময়ই এই খেলার কেন্দ্রে থাকবে।