TheInfoPort
ইতিহাস

মিশরের ফারাও: দেবতা রাজা নাকি শাসক?

STLRAxis Team

প্রাচীন মিশরের ফারাওরা ছিলেন একাধারে রাজা, যোদ্ধা এবং ধর্মীয় নেতা। প্রায় তিন হাজার বছর ধরে তারা মিশর শাসন করেছেন এবং তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব ছিল ব্যাপক। ফারাওদের জীবনযাপন, তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভূমিকা এবং সমাজে তাদের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

ফারাওদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ

ফারাওদের শাসনের শুরু হয় মিশরের প্রথম দিকের রাজবংশগুলোর মাধ্যমে। প্রায় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা নারমার (Narmer), যিনি মেনেস (Menes) নামেও পরিচিত, তিনিই প্রথম ফারাও যিনি উচ্চ ও নিম্ন মিশরকে একত্রিত করেন। এর পর থেকে ফারাওরা মিশরের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন।

প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে ফারাওদের শাসনকালকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা হয়, যেমন:

  • আর্লি ডাইনাস্টিক পিরিয়ড (Early Dynastic Period)
  • ওল্ড কিংডম (Old Kingdom)
  • ফার্স্ট ইন্টারমিডিয়েট পিরিয়ড (First Intermediate Period)
  • মিডল কিংডম (Middle Kingdom)
  • সেকেন্ড ইন্টারমিডিয়েট পিরিয়ড (Second Intermediate Period)
  • নিউ কিংডম (New Kingdom)
  • থার্ড ইন্টারমিডিয়েট পিরিয়ড (Third Intermediate Period)
  • লেইট পিরিয়ড (Late Period)

এই সময়কালে অনেক বিখ্যাত ফারাও এসেছেন, যাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন খুফু (Khufu), যিনি গিজার পিরামিড তৈরি করেন; তুতেনখামুন (Tutankhamun), যাঁর সমাধি অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কৃত হওয়ায় তিনি বিখ্যাত; এবং ক্লিওপেট্রা (Cleopatra), যিনি ছিলেন মিশরের শেষ ফারাও।

ফারাওদের ক্ষমতা ও ভূমিকা

ফারাওরা ছিলেন মিশরের সর্বোচ্চ শাসক। তাদের হাতে ছিল অসীম ক্ষমতা। তারা আইন প্রণয়ন করতেন, কর সংগ্রহ করতেন এবং দেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেন। ফারাওদের প্রধান কাজগুলোর মধ্যে ছিল:

  • রাজনৈতিক নেতৃত্ব: ফারাওরা ছিলেন দেশের প্রধান রাজনৈতিক নেতা। তাদের নির্দেশেই সবকিছু পরিচালিত হতো।
  • সামরিক নেতৃত্ব: ফারাওরা ছিলেন সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। দেশের সীমান্ত রক্ষা এবং যুদ্ধ পরিচালনা তাদের দায়িত্ব ছিল।
  • ধর্মীয় নেতৃত্ব: ফারাওদের মনে করা হতো দেবতাদের প্রতিনিধি। তারা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন এবং মন্দিরগুলোর তত্ত্বাবধান করতেন।
  • অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: দেশের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল ফারাওদের হাতে। তারা কৃষিকাজ, বাণিজ্য এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন।

ফারাওদের জীবনযাপন

ফারাওরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। তাদের প্রাসাদগুলো ছিল বিশাল এবং সুন্দর। তারা মূল্যবান পোশাক পরতেন এবং সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান রত্ন ব্যবহার করতেন। ফারাওদের খাবার ছিল অত্যন্ত উন্নত মানের এবং তাদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের আয়োজন থাকত।

ফারাওদের পরিবারের সদস্যরাও বিশেষ মর্যাদা পেতেন। তাদের স্ত্রীরা ছিলেন ফারাওদের প্রধান সহযোগী এবং তাদের সন্তানরা উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হতেন।

ফারাওদের ধর্মীয় বিশ্বাস

প্রাচীন মিশরীয়দের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল বহুদেবতাবাদী। তারা বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে ফারাওরা দেবতাদের বংশধর। ফারাওদের মৃতদেহ মমি করে সমাধিতে রাখা হতো, কারণ তারা বিশ্বাস করতেন যে মৃত্যুর পরেও তাদের জীবন আছে।

মিশরীয়দের প্রধান দেব-দেবী ছিলেন:

  • রা (Ra): সূর্যদেবতা
  • ওসিরিস (Osiris): মৃতদের দেবতা
  • আইসিস (Isis): জাদু ও সুরক্ষার দেবী
  • হোরাস (Horus): আকাশের দেবতা

ফারাওরা এই দেব-দেবীদের সন্তুষ্ট করার জন্য বিভিন্ন মন্দির নির্মাণ করতেন এবং নিয়মিত পূজা করতেন।

সমাজের উপর ফারাওদের প্রভাব

ফারাওদের শাসনের ফলে মিশরের সমাজ এবং সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব পড়েছিল। তারা বিভিন্ন স্থাপত্যকীর্তি তৈরি করেন, যা আজও মিশরীয় সভ্যতার পরিচয় বহন করছে। তাদের সময়ে শিল্পকলা, বিজ্ঞান এবং সাহিত্যের উন্নতি ঘটেছিল।

ফারাওদের তৈরি করা পিরামিড, মন্দির এবং অন্যান্য স্থাপত্যকীর্তিগুলো তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির প্রতীক। এগুলোর মাধ্যমে তারা নিজেদের অমর করে রেখেছেন।

ফারাওরা শুধু শাসক ছিলেন না, তারা ছিলেন মিশরের জনগণের কাছে ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি। তাদের জীবনযাপন, ক্ষমতা এবং বিশ্বাস মিশরের ইতিহাসকে আজও প্রভাবিত করে।