মহাসাগরের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শিকারি হিসেবে পরিচিত গ্রেট হোয়াইট শার্ক (Great White Shark) সমুদ্রের খাদ্য শৃঙ্খলের শীর্ষে অবস্থান করে। বৈজ্ঞানিক নাম Carcharodon carcharias, এই প্রজাতিটি আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় শিকারি হাঙ্গরের মধ্যে অন্যতম।
গ্রেট হোয়াইট শার্কের দৈর্ঘ্য সাধারণত ২০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে এবং ওজন ৫,০০০ পাউন্ডের বেশি হয়। এদের শরীরের উপরের অংশ ধূসর বা নীলাভ-ধূসর রঙের, আর নীচের অংশ সাদা। এই রঙের বৈশিষ্ট্য তাদের শিকার করতে সাহায্য করে, কারণ উপর থেকে দেখলে সমুদ্রের গভীর রঙের সাথে মিশে যায় এবং নীচ থেকে দেখলে আকাশের আলোর সাথে মিশে যায়।
গ্রেট হোয়াইট শার্ক বিশ্বের সমস্ত মহাসাগরে পাওয়া যায়। তবে এরা মূলত উপকূলীয় জলে বাস করে, যেখানে তাপমাত্রা ১২-২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। এরা প্রধানত দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূল এবং চিলির জলসীমায় দেখা যায়।
গ্রেট হোয়াইট শার্ক একটি সর্বভুক মাংসাশী প্রাণী। এদের প্রধান খাদ্য:
এরা শিকার করার সময় অত্যন্ত কৌশলী। প্রথমে নীচ থেকে দ্রুত উপরে উঠে আসে এবং শক্তিশালী দাঁত দিয়ে শিকারকে আক্রমণ করে। একটি গ্রেট হোয়াইট শার্কের ৩০০টিরও বেশি ত্রিকোণাকার ধারালো দাঁত থাকে, যা প্রতিনিয়ত নতুন দাঁত দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
গ্রেট হোয়াইট শার্ক জীবিত বাচ্চা প্রসব করে। গর্ভধারণের সময়কাল প্রায় ১২-১৮ মাস। একবারে ২-১৪টি বাচ্চা জন্ম নেয়। জন্মের সময় বাচ্চাদের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ ফুট হয়। এরা প্রায় ৭০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
গ্রেট হোয়াইট শার্ক বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত। এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রধান কারণগুলো:
বিভিন্ন দেশ এই প্রজাতি রক্ষায় আইন প্রণয়ন করেছে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সংরক্ষণে কাজ করছে।
বিজ্ঞানীরা গ্রেট হোয়াইট শার্কের আচরণ, প্রজনন এবং বাস্তুতন্ত্রে এদের ভূমিকা নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করছেন। স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং ও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এদের জীবন সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে।
সিনেমা ও মিডিয়ার প্রভাবে গ্রেট হোয়াইট শার্ক সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। বাস্তবে, মানুষের উপর আক্রমণের ঘটনা খুবই কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা মানুষকে এড়িয়ে চলে। তবে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন, কারণ এরা প্রকৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী শিকারিদের একটি।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন যে গ্রেট হোয়াইট শার্কের মস্তিষ্কের আকার তুলনামূলকভাবে বড় এবং এরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। এদের ইন্দ্রিয়গুলো অত্যন্ত উন্নত। তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি দিয়ে এরা দূর থেকে রক্তের গন্ধ পায়। এছাড়াও এদের রয়েছে:
ধারণা করা হত যে গ্রেট হোয়াইট শার্ক একাকী জীবন যাপন করে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে এদের মধ্যে একটি জটিল সামাজিক কাঠামো রয়েছে। এরা নির্দিষ্ট এলাকায় একত্রে শিকার করে এবং নির্দিষ্ট অধিক্ষেত্র নিয়ে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে।
গ্রেট হোয়াইট শার্ক তাদের পরিবেশের সাথে চমৎকারভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এমন যে ঠান্ডা পানিতেও সক্রিয় থাকতে পারে। এদের শরীরের গঠন এমন যে কম শক্তি ব্যয় করে দীর্ঘ দূরত্ব সাঁতার কাটতে পারে।
সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রে গ্রেট হোয়াইট শার্কের ভূমিকা অপরিসীম। এরা:
জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্র দূষণের কারণে গ্রেট হোয়াইট শার্কের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি এদের প্রজনন ও খাদ্যাভ্যাসে প্রভাব ফেলছে। প্লাস্টিক দূষণ ও তেল দূষণ এদের বাসস্থান ধ্বংস করছে। এছাড়া অবৈধ শিকার এখনও একটি বড় সমস্যা।
গ্রেট হোয়াইট শার্ক পর্যটন শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শার্ক কেজ ডাইভিং এবং শার্ক দর্শনের ব্যবস্থা রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং মেক্সিকোতে এই ধরনের পর্যটন থেকে কোটি কোটি ডলার আয় হয়। এটি স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করে।
গ্রেট হোয়াইট শার্ক মানুষের সংস্কৃতিতে গভীর ছাপ ফেলেছে। বিভিন্ন দেশের লোককথা, কিংবদন্তি এবং সাহিত্যে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। হলিউডের বিখ্যাত ‘জস’ সিনেমা গ্রেট হোয়াইট শার্কের ভয়ঙ্কর রূপ তুলে ধরেছে। তবে এই ধরনের চিত্রায়ন অনেক সময় অতিরঞ্জিত এবং বাস্তবতার সাথে মেলে না।
বিশ্বের অনেক দেশ গ্রেট হোয়াইট শার্ক সংরক্ষণে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে:
এই সকল প্রচেষ্টার ফলে গ্রেট হোয়াইট শার্কের সংখ্যা ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। তবে এদের সংরক্ষণে আরও অনেক কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে।