ভূতুড়ে জাহাজ বা “Ghost Ship” নিয়ে গল্প-কাহিনী শুনতে আমরা অনেকেই ভালোবাসি। এই জাহাজগুলো সমুদ্রে ভেসে বেড়ায়, কিন্তু এর নাবিক বা আরোহীদের কোনো চিহ্ন থাকে না। এমনই এক রহস্যে মোড়া জাহাজ হলো ম্যারি সেলেস্ট (Mary Celeste)। এর গল্প আজও মানুষকে শিহরিত করে।
১৮৭২ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর, আটলান্টিক মহাসাগরে একটি বাণিজ্যিক জাহাজ খুঁজে পাওয়া যায়, যার নাম ছিল ম্যারি সেলেস্ট। জাহাজটি নিউ ইয়র্ক থেকে জেনোয়া যাচ্ছিল। কিন্তু জাহাজটিকে যখন খুঁজে পাওয়া যায়, তখন সেটি সম্পূর্ণ খালি ছিল। অথচ জাহাজে যথেষ্ট খাবার, পানীয় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল। তাহলে নাবিক এবং যাত্রীরা কোথায় গেলেন?
ম্যারি সেলেস্ট মূলত একটি ‘ব্রিগ্যান্টাইন’ জাহাজ ছিল। এটি ১৮৬১ সালে “অ্যামাজন” নামে তৈরি করা হয়েছিল। পরে এর নাম পরিবর্তন করে ম্যারি সেলেস্ট রাখা হয়। ১৮৭২ সালের ৫ই নভেম্বর, ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন ব্রিগসের নেতৃত্বে নিউ ইয়র্ক থেকে জেনোয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে জাহাজটি। জাহাজে ক্যাপ্টেন ব্রিগসের স্ত্রী, তাদের দুই বছরের মেয়ে এবং আরও সাতজন নাবিক ছিলেন।
এক মাস পর, ৪ঠা ডিসেম্বর, ‘ডেই গ্রেশিয়া’ নামের একটি জাহাজ ম্যারি সেলেস্টকে আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসতে দেখে। ডেই গ্রেশিয়ার নাবিকেরা ম্যারি সেলেস্টের কাছে গিয়ে দেখে যে, জাহাজে কোনো মানুষ নেই। কিন্তু জাহাজটি অক্ষত ছিল। পালগুলো তখনও লাগানো ছিল, মালপত্র ঠিকঠাক ছিল এবং জাহাজের ডেকে কোনো ধ্বংসের চিহ্নও ছিল না। শুধু লাইফবোটটি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ম্যারি সেলেস্টের রহস্য নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো:
নাবিকদের অন্তর্ধান: জাহাজের নাবিক এবং যাত্রীরা কেন এবং কীভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল, তা আজও এক রহস্য।
কোনো সংঘাতের চিহ্ন নেই: জাহাজে কোনো মারামারি বা সংঘর্ষের চিহ্ন ছিল না। সবকিছু শান্তভাবে ছিল।
জীবনরক্ষাকারী নৌকার অভাব: জাহাজের লাইফবোটটি খুঁজে পাওয়া যায়নি, যা থেকে মনে করা হয়, নাবিকেরা হয়তো নৌকা করে পালানোর চেষ্টা করেছিল।
খাবার ও পানীয়: জাহাজে ছয় মাসের খাবার ও পানীয় ছিল। তাহলে কেন নাবিকরা জাহাজ ছেড়ে চলে গেল?
জাহাজের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র: নাবিকদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, যেমন - পোশাক, পাইপ, এবং টাকা-পয়সা সবই জাহাজে ছিল।
ম্যারি সেলেস্টের রহস্যের কোনো সঠিক সমাধান আজও পাওয়া যায়নি। তবে কিছু সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে:
সমুদ্রের ঝড়: কোনো শক্তিশালী ঝড়ের কবলে পড়ে হয়তো নাবিকেরা আতঙ্কিত হয়ে জাহাজ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল।
জলদস্যুদের আক্রমণ: অনেকে মনে করেন, জলদস্যুরা হয়তো জাহাজ আক্রমণ করে নাবিকদের হত্যা করে থাকতে পারে। তবে জাহাজে লুটপাটের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
বিষক্রিয়া: জাহাজে থাকা খাবারে বিষক্রিয়া হওয়ার কারণে হয়তো নাবিকেরা জাহাজ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল।
অতিরিক্ত মদ্যপান: নাবিকেরা অতিরিক্ত মদ্যপান করে জাহাজ থেকে পড়ে গিয়ে থাকতে পারে।
বিদ্রোহ: জাহাজে নাবিকদের মধ্যে বিদ্রোহ হয়েছিল, এমন সম্ভাবনাও অনেকে মনে করেন।
ম্যারি সেলেস্টের ঘটনা আজও এক অমীমাংসিত রহস্য। এই জাহাজটি যেন এক ভূতুড়ে গল্পের মতো, যা আজও মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। এর নাবিকদের কী হয়েছিল, তা হয়তো কখনোই জানা যাবে না। তবে ম্যারি সেলেস্টের গল্পটি চিরকাল রহস্য আর কল্পনার জগতে বেঁচে থাকবে।