আমরা যখন স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ ব্যবহার করি, তখন আমরা ক্লাসিকাল কম্পিউটিং ব্যবহার করি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা একটি নতুন ধরনের কম্পিউটিং নিয়ে কাজ করছেন যা আমাদের চিন্তার সীমানা ছাড়িয়ে যায় - এটাই হল কোয়ান্টাম কম্পিউটিং।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কি?
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং হল এমন একটি প্রযুক্তি যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি ব্যবহার করে তথ্য প্রক্রিয়া করে। সাধারণ কম্পিউটারের বিট (0 বা 1) এর পরিবর্তে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিউবিট ব্যবহার করে।
কিউবিট কি?
কিউবিট (Qubit) হল কোয়ান্টাম বিট। একটি সাধারণ বিটের মতো নয়, একটি কিউবিট একই সময়ে 0 এবং 1 উভয় অবস্থায় থাকতে পারে। এই অনন্য বৈশিষ্ট্যকে “সুপারপোজিশন” বলা হয়। এটি একটি সিক্কা একই সময়ে হেড এবং টেইল উভয় দিকে ঘোরার মতো।
ইতিহাস ও প্রধান ব্যক্তিত্ব
প্রাথমিক ধারণা (১৯৮০-১৯৯০)
- রিচার্ড ফাইনম্যান (১৯৮২): প্রথম কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ধারণা প্রস্তাব করেন
- ডেভিড ডয়েচ (১৯৮৫): প্রথম কোয়ান্টাম অ্যালগরিদম তৈরি করেন
বিকাশের যুগ (১৯৯০-২০১০)
- পিটার শর (১৯৯৪): বিখ্যাত শর’স অ্যালগরিদম আবিষ্কার করেন
- আইবিএম (১৯৯৫): প্রথম ২-কিউবিট কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করে
সাধারণ কম্পিউটার vs কোয়ান্টাম কম্পিউটার
সাধারণ কম্পিউটার:
আমাদের সাধারণ কম্পিউটার বিট (bit) ব্যবহার করে। একটি বিট হয় 0 অথবা 1 হতে পারে। এটি একটি লাইট সুইচের মতো - যা হয় চালু (1) অথবা বন্ধ (0) থাকতে পারে।
উদাহরণ: 4টি বিট দিয়ে আমরা একবারে শুধুমাত্র একটি সংখ্যা প্রকাশ করতে পারি, যেমন:
- 0000 = 0
- 0001 = 1
- 0010 = 2 ইত্যাদি
কোয়ান্টাম কম্পিউটার:
কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিউবিট (qubit) ব্যবহার করে। একটি কিউবিট অনেকটা একটি ঘূর্ণায়মান কয়েনের মতো:
- যেমন একটি কয়েন ঘোরার সময় হেড এবং টেইল দুটোই একসাথে থাকে
- তেমনি একটি কিউবিট 0 এবং 1 দুটি অবস্থায় একই সময়ে থাকতে পারে
- এই অবস্থাকে বলা হয় সুপারপোজিশন (superposition)
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল বৈশিষ্ট্য
১. সুপারপোজিশন (Superposition):
চলুন একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝাই:
- আপনার 4টি সাধারণ বিট আছে = একবারে একটি সংখ্যা (0-15)
- আপনার 4টি কিউবিট আছে = একবারে 16টি সংখ্যার সব সম্ভাবনা (0-15)
- অর্থাৎ 4টি কিউবিট দিয়ে 16টি সংখ্যার উপর একই সময়ে কাজ করা যায়
২. এনট্যাঙ্গলমেন্ট (Entanglement):
দুটি যমজ বোনের মতো:
- একজন যা করে, অন্যজন তার বিপরীত করে
- দুটি কিউবিট এনট্যাঙ্গল হলে, একটির অবস্থা জানলেই অন্যটির অবস্থা জানা যায়
- এটি দ্রুত গণনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ
কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিভাবে গণনা করে
১. ডেটা প্রস্তুতি:
- প্রথমে সব কিউবিট 0 অবস্থায় থাকে
- তারপর কিউবিটগুলোকে সুপারপোজিশনে আনা হয়
- এখন প্রতিটি কিউবিট 0 এবং 1 এর মিশ্রণে থাকে
২. গণনা প্রক্রিয়া:
a) কোয়ান্টাম গেট ব্যবহার:
- সাধারণ কম্পিউটারে AND, OR গেট থাকে
- কোয়ান্টাম কম্পিউটারে H (Hadamard), X, Y, Z গেট থাকে
- এই গেটগুলো কিউবিটের অবস্থা পরিবর্তন করে
b) প্যারালেল প্রসেসিং:
- সব কিউবিট একসাথে কাজ করে
- 100 কিউবিট = 2^100 সংখ্যার উপর একসাথে গণনা
- এজন্যই কোয়ান্টাম কম্পিউটার অনেক দ্রুত
৩. ফলাফল পাওয়া:
- কিউবিটগুলো মাপা হয়
- মাপার সময় সুপারপোজিশন ভেঙ্গে যায়
- সবচেয়ে সম্ভাব্য উত্তরটি পাওয়া যায়
বাস্তব উদাহরণ
১. নম্বর ফ্যাক্টরিং:
ধরুন, 15 কে ভাগ করতে হবে:
- সাধারণ কম্পিউটার: 1, 3, 5, 15 - একটা একটা করে চেক করে
- কোয়ান্টাম কম্পিউটার: সব সম্ভাব্য ভাগ একসাথে চেক করে
- ফলাফল: 3 × 5 = 15
২. ডেটাবেস সার্চ:
1000টি নাম্বারের মধ্যে একটি খুঁজতে:
- সাধারণ কম্পিউটার: 1000 বার চেক করতে হবে
- কোয়ান্টাম কম্পিউটার: মাত্র 32 বার চেক করেই পেয়ে যাবে
চ্যালেঞ্জ
ডিকোহেরেন্স:
কিউবিট খুব নাজুক সামান্য শব্দ/তাপ পেলেই সুপারপোজিশন নষ্ট হয় তাই অতি শীতল (-273°C) তাপমাত্রায় রাখতে হয়
ত্রুটি সংশোধন:
কিউবিট ত্রুটি করতে পারে
বেশি কিউবিট = বেশি ত্রুটির সম্ভাবনা
ত্রুটি সংশোধনের জন্য অতিরিক্ত কিউবিট লাগে
অত্যন্ত ব্যয়বহুল প্রযুক্তি
অতি নিম্ন তাপমাত্রা প্রয়োজন
বর্তমান অবস্থা
প্রধান প্রতিষ্ঠানসমূহ:
- গুগল: ৫৩-কিউবিট সাইকামোর প্রসেসর
- আইবিএম: ১২৭-কিউবিট ইগল প্রসেসর
- ইন্টেল: ৪৯-কিউবিট টাঙ্গো চিপ
সাম্প্রতিক অর্জন:
২০১৯ সালে গুগল “কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি” অর্জন করেছে, যা একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে এমন একটি সমস্যা সমাধান করা যা ক্লাসিকাল কম্পিউটারের জন্য অসম্ভব।
প্রয়োগক্ষেত্র
বর্তমান ব্যবহার:
-
ক্রিপ্টোগ্রাফি: নিরাপদ ডেটা এনক্রিপশন
-
ড্রাগ ডিজাইন: নতুন ঔষধ আবিষ্কার
-
আবহাওয়া পূর্বাভাস: জটিল আবহাওয়া মডেল তৈরি
ভবিষ্যৎ ব্যবহার:
- আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স: উন্নত মেশিন লার্নিং
- লজিস্টিকস: জটিল সাপ্লাই চেইন অপ্টিমাইজেশন
- আর্থিক মডেলিং: জটিল আর্থিক পূর্বাভাস
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
আগামী দশকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং আরও শক্তিশালী ও ব্যবহারযোগ্য হবে বলে আশা করা যায়। এর প্রধান লক্ষ্যগুলি:
- ১,০০০+ কিউবিট প্রসেসর তৈরি
- ত্রুটি সংশোধন প্রযুক্তির উন্নতি
- বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ছোট ও সাশ্রয়ী ডিভাইস
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং একটি বিপ্লবী প্রযুক্তি যা আমাদের কম্পিউটিং ক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। যদিও এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তবে এর সম্ভাবনা অসীম। আগামী কয়েক দশকে এই প্রযুক্তি আমাদের জীবনযাত্রাকে কীভাবে পরিবর্তন করবে তা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।