ডিজিটাল প্রযুক্তির ক্রমবিকাশে ব্লকচেইন একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। এটি শুধু ক্রিপ্টোকারেন্সির ভিত্তি নয়, বরং একটি বিপ্লবী প্রযুক্তি যা আমাদের ডিজিটাল লেনদেন ও তথ্য সংরক্ষণের ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে।
ব্লকচেইনের ধারণাটি প্রথম আসে ১৯৯১ সালে, যখন স্টুয়ার্ট হাবার এবং ডব্লিউ. স্কট স্টর্নেটা একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক সুরক্ষিত চেইন অফ ব্লকের ধারণা দেন। কিন্তু এর প্রকৃত বাস্তবায়ন ঘটে ২০০৮ সালে, যখন সাতোশি নাকামোতো নামে একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিটকয়েন হোয়াইট পেপার প্রকাশ করেন।
২০০৯ সালে প্রথম বিটকয়েন নেটওয়ার্ক চালু হয়। এরপর থেকে ব্লকচেইন প্রযুক্তি ক্রমাগত বিকশিত হয়েছে। ২০১৫ সালে ইথেরিয়াম প্ল্যাটফর্ম চালু হওয়ার পর এই প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বেড়ে যায়।
ব্লকচেইন হলো একটি ডিজিটাল লেজার বা হিসাবের খাতা, যা বিকেন্দ্রীভূতভাবে সংরক্ষিত থাকে। এখানে সব তথ্য ব্লক আকারে সাজানো থাকে এবং প্রতিটি ব্লক আগের ব্লকের সাথে ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ দিয়ে যুক্ত থাকে।
ব্লকচেইনে যখন কোন লেনদেন হয়, তা একটি নতুন ব্লকে সংরক্ষিত হয়। এই ব্লক তৈরির প্রক্রিয়াকে বলা হয় মাইনিং। মাইনাররা জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে নতুন ব্লক তৈরি করে। নতুন ব্লক তৈরি হলে তা নেটওয়ার্কের সবার কাছে যাচাই হয় এবং সবার সম্মতিতে শিকলের সাথে যুক্ত হয়।
ব্লকচেইনের কার্যপ্রণালী বোঝার জন্য একটি গ্রামের সমবায় সমিতির কথা ভাবুন। যেখানে:
১. প্রতিটি সদস্যের কাছে একই হিসাবের খাতা থাকে
২. কেউ কোন লেনদেন করলে সবাই তা যাচাই করে
৩. সবার সম্মতিতে নতুন তথ্য যোগ হয়
৪. একবার লেখা তথ্য আর পরিবর্তন করা যায় না
বর্তমানে ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে:
আর্থিক খাতে:
ডিজিটাল ব্যাংকিং: বিভিন্ন ব্যাংক ক্রস-বর্ডার পেমেন্টের জন্য ব্লকচেইন ব্যবহার করছে
ক্রিপ্টোকারেন্সি: বিটকয়েন, ইথেরিয়াম সহ হাজারো ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহৃত হচ্ছে
সাপ্লাই চেইন:
ওয়ালমার্ট তাদের খাদ্য সরবরাহ ট্র্যাক করতে ব্লকচেইন ব্যবহার করছে
মাইক্রোসফট এজিয়র ব্লকচেইন সার্ভিস দিচ্ছে
আইবিএম ফুড ট্রাস্ট নেটওয়ার্ক চালু করেছে
স্বাস্থ্যসেবা:
এসটন ইউনিভার্সিটি রোগীর তথ্য সংরক্ষণে ব্লকচেইন ব্যবহার করছে
মেডিব্লক প্ল্যাটফর্ম ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানে ব্যবহৃত হচ্ছে
শিক্ষা:
এমআইটি ডিজিটাল সার্টিফিকেট ইস্যু করছে ব্লকচেইনে
সোনি গ্লোবাল এডুকেশন ব্লকচেইন ভিত্তিক শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে
সুবিধা:
নিরাপত্তা: ডেটা পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব
স্বচ্ছতা: সব লেনদেন সবার কাছে দৃশ্যমান
খরচ কম: মধ্যস্থতাকারী না থাকায় খরচ কম
দ্রুত: বিশ্বব্যাপী লেনদেন দ্রুত সম্পন্ন হয়
চ্যালেঞ্জ:
প্রযুক্তিগত জটিলতা: সাধারণ মানুষের বোঝা কঠিন
শক্তির অপচয়: মাইনিং এ প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হয়
আইনি অনিশ্চয়তা: অনেক দেশে এখনো আইনি কাঠামো তৈরি হয়নি
স্কেলেবিলিটি: বড় আকারে ব্যবহারে সমস্যা হয়
ব্লকচেইন প্রযুক্তি ক্রমশ আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠছে। এর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তবে এর সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান ও দক্ষতা।