চলুন ৪০০০ বছর পিছনে ফিরে যাই। কল্পনা করুন, পিরামিড তৈরি করা হচ্ছে অঙ্ক ছাড়া, বা রকেট উৎক্ষেপণ করা হচ্ছে সমীকরণ ছাড়া। অসম্ভব লাগে, তাই না? সংখ্যা হল সভ্যতার মেরুদণ্ড, আর ক্যালকুলেটর হল তার বিশ্বস্ত সঙ্গী। একটি সাধারণ গিয়ার-ভিত্তিক গ্যাজেট থেকে শুরু করে আজকের পকেট-সাইজের সুপারকম্পিউটার—এই যাত্রা কেমন ছিল? চলুন, জেনে নিই কিভাবে ক্যালকুলেটর আপনার স্মার্টফোনের পূর্বপুরুষ হয়ে উঠল।
প্রাচীনকালে গণনার সবচেয়ে জনপ্রিয় সরঞ্জাম ছিল অ্যাবাকাস। এটিকে কাঠের তৈরি এক্সেল স্প্রেডশিট বললে ভুল হবে না! দশমিক পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে অ্যাবাকাস ব্যবহার করে যোগ, বিয়োগ, গুণ এবং ভাগ করা যেত। এটি ছিল মস্তিষ্কের শক্তির উপর নির্ভরশীল একটি সরঞ্জাম, যা আজও কিছু জায়গায় ব্যবহৃত হয়।
খ্রিস্টপূর্ব ১০০ সালে তৈরি এই যন্ত্রটি ছিল এক রহস্যময় আবিষ্কার। এটি গ্রহ-নক্ষত্রের গতি গণনা করতে পারত, এবং অনেকেই এটিকে বিশ্বের প্রথম অ্যানালগ কম্পিউটার বলে মনে করেন। যদিও এর প্রকৃত ব্যবহার এবং প্রযুক্তি আজও গবেষকদের জন্য এক ধাঁধা।
১৬১৪ সালে জন নেপিয়ার লগারিদমের উপর ভিত্তি করে “নেপিয়ারের বোনস” তৈরি করেন, যা দ্রুত গুণ ও ভাগ করতে সাহায্য করত। এরপর আসে স্লাইড রুল, যা প্রকৌশলীদের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এই সরঞ্জামগুলি ব্যাটারি ছাড়াই চলত!
মাত্র ১৯ বছর বয়সে ব্লেইজ প্যাসকেল একটি যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর তৈরি করেন, যা যোগ ও বিয়োগ করতে পারত। এটি ছিল যান্ত্রিক গণনার প্রথম বড় পদক্ষেপ।
গটফ্রিড লাইবনিজ প্যাসকেলের যন্ত্রকে আরও উন্নত করে স্টেপড রেকোনার তৈরি করেন, যা গুণ ও ভাগও করতে পারত। তিনি বাইনারি সিস্টেমের ধারণাও দিয়েছিলেন, যদিও সেটি তখন জনপ্রিয় হয়নি। পরবর্তীতে কম্পিউটার প্রযুক্তি এই ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করে।
চার্লস ব্যাবেজ ডিফারেন্স ইঞ্জিন নামে একটি যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর ডিজাইন করেন, যা জটিল গণনা করতে সক্ষম ছিল। এটি স্টিম-পাঙ্ক যুগের একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার ছিল, কিন্তু প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে এটি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়নি।
ট্রানজিস্টরের আবিষ্কার যান্ত্রিক যন্ত্রের যুগের অবসান ঘটায়। এটি ইলেকট্রনিক ক্যালকুলেটরের যুগের সূচনা করে, যেখানে বিশাল যন্ত্রগুলি ছোট এবং দ্রুত হয়ে উঠল।
ক্যাল টেক প্রথম হ্যান্ডহেল্ড ইলেকট্রিক ক্যালকুলেটর তৈরি করে, যার দাম ছিল ২,৫০০ ডলার! এটি ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, কিন্তু প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতির সাথে সাথে এটি সাশ্রয়ী হয়ে উঠল।
ক্যালকুলেটর এবং কম্পিউটারের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বাইনারি লজিক, ALU (Arithmetic Logic Unit), এবং CPU—এই সবই ক্যালকুলেটর প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি। ENIAC-এর মতো প্রথম কম্পিউটারগুলি ক্যালকুলেটর প্রযুক্তি ব্যবহার করেই তৈরি হয়েছিল।
এডিথ ক্লার্ক ছিলেন একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, যিনি ক্যালকুলেটর প্রযুক্তিকে বিদ্যুৎ গ্রিডের গণনায় ব্যবহার করেছিলেন।
জ্যাক কিলবি ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC) উদ্ভাবন করেন, যা ক্যালকুলেটর এবং কম্পিউটারকে ছোট এবং শক্তিশালী করে তুলেছিল। IC এর উদ্ভাবন আমাদেরকে দিয়েছে কম্পিউটার মাইক্রোচিপ এর মত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ।
ক্লাইভ সিনক্লেয়ার সাশ্রয়ী ক্যালকুলেটর তৈরি করে ১৯৭০-এর দশকে এক বিপ্লব ঘটান, যদিও তার কোম্পানি আর্থিক সংকটে পড়েছিল।
ক্যালকুলেটর ক্লাসরুমে প্রবেশের পর থেকে এই বিতর্ক চলছে। কিছু মানুষ মনে করেন এটি গণিত শেখার সহায়ক, আবার কিছু মানুষ মনে করেন এটি ছাত্রদের মস্তিষ্কের বিকাশে বাধা দেয়।
স্টার ট্রেকের ট্রাইকর্ডার থেকে হ্যারি পটারের অ্যারিথম্যান্সি—ক্যালকুলেটর এবং গণনা যন্ত্রগুলি পপ কালচারে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
AI এবং মেশিন লার্নিং এর উন্নতির সাথে সাথে, ভবিষ্যতে AI ক্যালকুলেটরগুলি মানব গণিতবিদদের প্রতিস্থাপন করতে পারে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। এ নিয়ে আর জানতে চাইলে পড়তে পারেন আমাদের AI কি মানুষের চাকরির হুমকিস্বরূপ, ভবিষ্যতে ফেলবে কি প্রভাব? ব্লগটি ।
ক্যালকুলেটরের ইতিহাস হল মানব সভ্যতার অগ্রগতির একটি প্রতিচ্ছবি। প্রাচীন অ্যাবাকাস থেকে আজকের AI-চালিত যন্ত্র—এই যাত্রা আমাদের প্রযুক্তির প্রতি ভালোবাসা এবং উদ্ভাবনের শক্তিকে প্রতিফলিত করে। ভবিষ্যতে ক্যালকুলেটর আরও কতটা উন্নত হবে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু একথা নিশ্চিত, সংখ্যা এবং গণনা মানব সভ্যতার সাথে চিরকাল থাকবে।